দেশব্যাপী মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। বিশিষ্টজনদের অনেকেই একে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ডেঙ্গু প্রকোপে পড়েছে ৬১ জেলার লোকজন। মারা গেছেন বিভিন্ন স্তরের মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছেন ডাক্তার, সরকারি কর্মকর্তা, তাদের স্বজন এবং বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও। গোটা দেশ যখন ডেঙ্গু জ্বরে কাঁপছে, তখন এর থেকে ব্যতিক্রম নয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের (ঢাবি) চিত্রও। ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্তের খবরে উদ্বেগ বাড়ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সর্বশেষ ঢাবি শিক্ষার্থী ফিরোজ কবীর স্বাধীনের মৃত্যুর মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা প্রকাশ্যে আসে। প্রায় সব হলের চিত্র একই।
বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলোর শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে এ পর্যন্ত অন্তত ১৯৬ জন শিক্ষার্থীর ডেঙ্গু আক্রান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বর্ষা ঋতুতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহক এডিস মশার বংশবিস্তারে সহায়ক পরিবেশ থাকায় ডেঙ্গু তথা মৃত্যুঝুঁকিতে দিনাতিপাত করছেন বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীরা। রোগ প্রতিরোধে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন সচেতনতা বৃদ্ধিসহ কতিপয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা যথাযথ মনে করছেন না শিক্ষার্থীরা। এই অবস্থায় ক্লাস বন্ধ করে দিয়ে ক্যাম্পাসে ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তারা। এ দাবিতে ভিসিকে স্মারকলিপিও প্রদান করা হয়েছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে।
সর্বশেষ ক্রমবর্ধমান এ আতঙ্কের মধ্যেই গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ডিভাইস স্থাপন করা হয়েছে। এতে প্রথম দিনে ১৬৮ জন শিক্ষার্থীর রক্ত পরীক্ষা করে ১৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেয়েদের পাঁচটি হলসহ বিশ^বিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ পর্যন্ত অন্তত ১৯৫ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে মেয়েদের পাঁচটি হলে অন্তত ৩৫ জন ছাত্রীর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। বাকি ১৬১ জন ছাত্র। এর মধ্যে ফজলুল হল মুসলিম হলে অন্তত ২০ জন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ২০ জন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শুধু বারান্দার বাসিন্দাদের মধ্যেই অন্তত ১২ জন, মাস্টারদা সূর্য সেন হলে ১৫ জন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ১১ জন, জসীম উদ্দীন হলে ১০ জন, অমর একুশে হলে আটজন, জগন্নাথ হলে পাঁচজন, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে আটজন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ১৯ জন, স্যার এ এফ রহমান হলে ছয়জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ১১ জন (এর মধ্যে একজন মারা গেছেন), বিজয় একাত্তর হলে ১৪ জন। বিজয় একাত্তর হলের একটি সূত্র জানায় ৫১ জনের মতো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৩১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং বাকিদের রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে তা জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্য দিকে মেয়েদের হলগুলোর মধ্যে কবি সুফিয়া কামাল হলে ১৫ জন, রোকেয়া হলে ছয়জন, শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে ছয়জন, শামসুন্নাহার হলে ছয়জন, কুয়েত মৈত্রী হলে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ফজলুল হল মুসলিম হলের ১০১৭ নম্বর কক্ষে পাঁচজন, ১০১৫-এ পাঁচজন, ১০০৪-এ তিনজন, ১৩৫-এ দু’জন, ৪০০৮-এ একজন, ৩০০৮-এ একজন এবং ২০১৯-এ তিনজন। সূর্য সেন হলে লাদেন গুহাখ্যাত ১৭৯ নম্বর কক্ষে সাতজন, ২২৬-এ দু’জন, ২৩০-এ একজন, ২৩৪-এ একজন, ২২৭-এ দু’জন, ২৩৮-এ একজন এবং ৩৫৭-তে একজন। কবি জসীম উদ্দীন হলের ৫৩১-এ দু’জন, ১১৩-তে একজন, ৪১৫-তে একজন ২০৮-এ একজন, ৩৩০-এ একজন, ১২৯-এ একজন, ২১৫-তে একজন এবং ৫১৪-তে দু’জন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের ২১০৭ নম্বর কক্ষে ১১ জন, ১১০২-এ তিনজন, ২১১৪-তে দু’জন এবং ১১০৪-এ চারজন। জিয়াউর রহমান হলে ৪২২ নম্বর কক্ষে একজন, ৪২৩-এ একজন, ২২৫, ২২৬ এবং ২২৭-এ মোট ছয়জন, ৪১৬-তে একজন, ১০৩-এ একজন এবং ১০৪-এ দু’জন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বারান্দায় থাকা শিক্ষার্থীদের ১২ জন। অমর একুশে হলে ৫০৩ (সালাম)-এ একজন, ১০৫-এ সাতজন। জগন্নাথ হলের ২২২-এ দু’জন, ২০০৪-এ একজন, ১০০২-এ একজন এবং ২১৩-তে একজন। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ৬ নম্বর কক্ষে চারজন, ১৫-তে একজন, ১০১৪-তে একজন এবং ১০১৩-তে দু’জন। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৩৫১-তে একজন, ৩৫২-তে একজন, ১০২০-এ একজন, এক্সটেনশনের গণরুমে ১২ জন, ১০১৩ ও ১০১৪-তে তিনজন এবং ৫৪৭-এ একজন। স্যার এ এফ রহমান হলে ৫২২-তে একজন, ৪১৯-এ একজন, ১০৮-এ তিনজন এবং ২০৬-এ একজন। বিজয় একাত্তর হলের পদ্মা ব্লকের ৭০০৩-এ একজন, ৬০০৬-এ একজন, ৬০১২ তে একজন, ২০০৭-এ তিনজন, ৯০০৬-এ একজন, যমুনা ব্লকের ৩০১০-এ একজন, ৬০০৯-এ একজন, ৫০১১-তে দু’জন, ৫০১২-তে একজন এবং ৬০১০-এ দু’জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৪২২ নম্বর কক্ষে একজন, ৪২০-এ একজন, ১১৯-এ দু’জন, ১১৩-তে চারজন, ১১৭-তে দু’জন। এ ছাড়া সদ্য মৃত বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বাধীন এই হলেরই শিক্ষার্থী।
অন্য দিকে মেয়েদের হলের মধ্যে সুফিয়া কামাল হলের ৮০৫ নম্বর কক্ষে একজন, ৫০৩-এ একজন, ৫০৪-এ একজন, ৫০৭-এ একজন, ৪০৬-এ একজন, ৮০৩-এ দু’জন, ৮০৪-এ দু’জন, ৮০৬-এ একজন, ৮০২-এ একজন, ৯০৯-এ একজন, ৬০৫-এ একজন, ৬১২-তে একজন এবং ৩০৫-এ একজন। রোকেয়া হল এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ে একজন, মেইন বিল্ডিং সেকেন্ড ফ্লোরে একজন, ৬৯ নম্বর কক্ষে একজন, ৭ মার্চ ভবন চতুর্থ তলায় একজন এবং ৫১৭ নম্বর কক্ষে দু’জন। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের ৫২০-এ একজন, ২০৬-এ একজন, ৪০৫-এ একজন, ৬১৪-তে একজন এবং ৩১৯-এ দু’জন। শামসুন্নাহার হলের ১০০২ নম্বর কক্ষে একজন, ১০০৬-তে একজন, ১০০২-এ দু’জন, ৩০০১- একজন এবং ২০৩০-এ একজন। এ ছাড়া বাংলাদেশে-কুয়েত মৈত্রী হলের ৩০৫-এ থেকে মাত্র একজন ছাত্রীর ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু হলের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শামীম আল মামুন বলেন, ছেলেদের হলে বিশেষ করে গণরুমের পরিবেশের কারণে সেখানে ডেঙ্গু বা অন্যান্য রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি থাকে।
এ দিকে ক্যাম্পাসের পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে ক্লাস বন্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে বিভাগের ছয় শিক্ষার্থী ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় পরীক্ষা স্থগিত করেছে আইন বিভাগ। ইংরেজি বিভাগসহ বেশ কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থী ক্লাস না করার নৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইন বিভাগের পরীক্ষা স্থগিত, ইংরেজি বিভাগসহ কয়েকটি বিভাগে ক্লাস বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে শিক্ষার্থীরা। ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং ক্যাম্পাসের বিষয়ে মন্তব্য জানতে বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামানকে মোবাইলে চেষ্টা করা হলে তার সংযোগটি ব্যস্ত পাওয়া যায়।
Leave a Reply